মিলন
গৌতম তালুকদার
মধুকে হারিয়ে দিশেহারা মল্লিকা।
বছর যেতে না যেতে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের
কাছে মল্লিকা আর ওর এক বছরের ছেলে যেন বাড়তি বোঝা হয়ে উঠেছে।লাঞ্ছনা গঞ্জনা এতো টাই চরমে উঠেছে, বাধ্য হয়ে বাড়ি ভাড়া খুঁজে বেরিয়ে আসতে হয়।দু'বেলা দু'মুঠো খেয়ে বেঁচে
থাকার জন্যে নামতে হয় রোজগারে'র রাস্তায়।
একজন বিশেষ পরিচিত মানুষের সাহায্যে নিয়ে একটি অফিসে কাজে'র ব্যবস্থা হয়।কিন্তু সব থেকে মুশকি'ল হল ছেলেকে নিয়ে। কার কাছে
রেখে যাবে কে আছে দেখবে ঐ টুকু দুধে'র বাচ্ছা টাকে। কোনো কূল কিনারা না পেয়ে সাথে করে নিয়ে যায় অফিসে।অফিসে'র কলিগরা প্রথমে কয়েক দিন কিছু না বললেও এখন বলতে শুরু করেছে। অফিসে'র বড় বাবু রমেন সাধু ওকে ডেকে বললেন-
ছেলেকে নিয়ে অফিসে আসা যাবে না।ছেলেকে কোথাও রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে তবেই যেন কাজে আসে,তা না হলে আসতে হবে না।
মল্লিকা'র মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে ,কি
করবে ও ভেবে উঠতে পারছে না।যদিও একটা কাজ পেলো তাও হাত ছাড়া হয়ে যাবে ..........!
অনেক করে রমেন সাধুকে বলে-
কয়েকটা দিন সময় দিতে একটু মানিয়ে নিতে কিন্তু রমেন সাধু'র এক কথা-ওর কোনো অসুবিধা ছিলো না। অন্য স্টাফরা
আপত্তি করছে ,ওদের কাজে'র অসুবিধা হচ্ছে।
কলিগদে'র কয়েক জনের কাছে অনুরোধ করে কয়েকটা দিন একটু মানিয়ে নিতে।
সকলেই বলে- রমেন স্যা'র যদি পারমিশন দেন তাহলে ওদের আর কি বলার আছে।
মল্লিকা কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না।রমেন সাধু সাফ জানিয়ে দেয় ওকে কাজে আসতে হবে না।
বাড়িতে ফিরে মল্লিকা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এক মাত্র বাপে'র বাড়ি সেও তো ওপার বাংলায়।আজ থেকে সাত বছর আগে মধু ওপার বাংলায় ওর দিদি'র বাড়ি বেড়াতে য়ায়।পাশের পাড়াতে মল্লিকাদের বাড়ি।মাস দুই থাকে মধু।পরিচয় হয় মল্লিকা'র সাথে। দুজন দুজনা'র প্রেমে পড়ে।
মধু মল্লিকাকে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসে এ
বাংলায় মধুদে'র বাড়িতে।
প্রথম থেকেই মল্লিকাকে তেমন ভাবে কেউ মেনে নিতে চায়নি।যন্ত্রনা বাজে ব্যবহার নির্যাতন সহ্য করে মধুর বুকে মাথা গুছে দিন কাটায় মল্লিকা।মধু ওকে ভীষন ভালোবাসে সব সময় বোঝাতো যাতে ও মাথা গরম না করে। বোলতো ওদের এমন দিন থাকবে না।একটা লোন পেতে অনেক চেষ্টা করছে,লোনটা পেয়ে গেলেই ওর সাপলাই এর ব্যবসা ভালো ভাবে করতে পারবে। কোনো মতে দু'টো বছর কষ্ট করতে পারলেই আলাদা ভাবে থাকার ব্যবস্থা ক'রে নেবে।ততো দিনে তো ছেলেও একটু বড় হয়ে উঠবে।
হায়রে মানুষের স্বপ্ন,বিধাতা'র ইচ্ছেতে তা পূরণ হয় আবার ভেঙ্গে যায় হঠাৎ করেই ছুটে আসে কোনো না কোনো অজানা অচেনা বিপদ ,আর কারো কারো স্বপ্ন থেকে জীবন পর্যন্ত কেড়ে নেন বিধাতা।কথায় বলে কপালে লিখন কে খন্ডাবে। অমানুষিক পরিশ্রমের ফলে হঠাৎ করেই কঠিন অসুখে পড়ে মাত্র এক মাসের মধ্যেই চলে যেতে হয় মধুকে এপৃথিবী থেকে,স্ত্রী,পুত্র,সজন পরিজনের মায়া ত্যাগ করে।ছয় মাসের ছেলেকে
নিয়ে মল্লিকা দাসী হয়ে থেকেও শ্বশুর বাড়ির লোকের মন পায় না। শেষে বাধ্য হয় বেরিয়ে
আসতে। মধুর রেখে যাওয়া সামান্য কিছু টাকা ঘর ভাড়া দিয়ে কোনো মতে দিন চলছিলো এ কাজটা পেয়ে একটু স্বস্তি'র নিঃশ্বাস পড়তে না পড়তেই .....!
সারা রাত ভেবেও কোনো কূল কিনারা করতে পারে না। ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ বসে থাকে
কিছু সময় বাদে কলে জল আনতে গেলে পাশের ঘরের ভারাটে বউ'টা জিজ্ঞাসা করে-
-আজ কাজে গেলে না যে ?
একটু চুপ থেকে বলে-
-কি করে যাবো অফিস থেকে সাফ বলে দিয়েছে ছেলেকে নিয়ে যাওয়া চলবে না। কি যে করি...!
-কিছু মনে করো না। তোমায় তো আগেই বলেছি
ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ওরা তোমায় কাজে
রাখবে না।অফিস তো আর তোমার অসুবিধে'র কথা শুনবে না। এখন কি করবে তাহলে ?
-ভাবছি একটু বেলা করে অফিসে যাবো। বড়
বাবুকে আর একবার অনুরোধ করে দেখি যদি ..
-দেখো চেষ্টা করে। তানা হলে ছেলেকে কোনো
অনাথ আশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করো।চাকরিটা
গেলে আর কি পাবে।শেষে লোকের বাড়ি বাড়ি বাসন মাজার কাজ করতে হবে।
কথাটাশুনতেই মল্লিকা'র বুকটা মোচড় দিয়ে
ওঠে,এক মাত্র ছেলে ছাড়া ওর তো আর কেউ নেই। ছেলেকে ছেড়ে কি করে থাকবে।দুঃখে কষ্টে দিন কাটলেও তো ওর মুখ দেখে বেঁচে আছে।
তাছারা শুনেছে অনাথ আশ্রমে রাখতে গেলেও সুপারি'শ লাগে।কে করবে সুপারি'শ,তেমন কেউ বা কারো সাথেই তো জানাশোনা নেই।
ওখানেও নাকি আজ'কাল পয়সা ছাড়া কাজ হয় না,বাচ্ছা রাখা য়ায় না।
দুপুরে ছেলে নিয়ে মল্লিকা অফিসে আসে রমেন বাবুর সাথে দেখা করে অনুরোধ করে অত্যন্ত এ মাসের যে বারো দিন বাকি আছে মাস শেষ হতে একটা দিন যদি ওকে কাজ কর'বার সুযোগ দেন এর মধ্যে ছেলের একটা ব্যবস্থা করে নিতে চেষ্টা করবে। রমেন বাবু ওকে বাইরে বসতে বলে এক বান্ডিল কাগজে সই করতে করতে কিছু একটা ভাবতে থাকেন মোবাইলে কাউকে ফোন করেন।
পিয়ন রতন,মল্লিকাকে চুপচাপ মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করে-
-কি হলো দিদি বড় বাবু কি বললেন ?
-কিছুই তো বললেন না ,বাইরে বসতে বললেন।
-ভেবো না বড় বাবু এমনিতে মানুষটা ভালো।
-কি জানি ভাই কিছুই তো বুঝতে পারছিনা জানি না কপালে কি আছে।
বড় বাবুর ঘর থেকে বেল বাজতেই রতন ছুটে যায়,বেড়িয়ে এসে মল্লিকাকে বড়বাবুর ঘরে
যেতে বলে নিজের কাজে চলে যায়।
মল্লিকা ভাবে ওকি বড় বাবুর পা জড়িয়ে ধরবে!
ভাবতে ভাবতে বড় বাবু্'র রুমে ঢোকে।
রমেন বাবু ওকে বসতে বলে।রতন এসে রমেন বাবুর হাতে একটা খাম দিয়ে চলে যায়।
রমেন বাবু মল্লিকা'র দিকে খামটা এগিয়ে দিয়ে বলেন-
-তোমার এমাসে'র পুরো মাইনে।একদিন কাজ না করলেও চলবে।
মল্লিকা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।তাহলে কাজটা গেলো, আর কোনো' আশাই থাকলো না!
ওকে ভাবতে দেখে রমেন বাবু হাসি মুখে বলে-
-এত কি ভাবছো ? তুমি বললে কদিনে'র মধ্যে
ছেলের একটা ব্যবস্থা করবে, বেশ তো ব্যবস্থা করে ফের চলে এসো। তোমার চাকরি থাকছে।
মল্লিকা কি বলবে কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
এতো মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়া। এমাসে'র মাইনে
দিয়ে বিদায় করা।
ওর মনের অবস্থা রমেন বাবু বুঝতে পেরে বলে--কোনো চিন্তা করোনা।ছেলেকে কোথাও রাখার ব্যবস্থা করেই চলে এসো।আমি আছি তোমার চাকরি যাবে না।
একটা ফোন আসতে'ই রমেন বাবু বলে-
-এবার এসো।দুজন ক্লায়েন্ট আসছে মিটিং আছে ওদের সাথে ।
মল্লিকা যেন সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। মুখ থেকে কোনো কথাই বেড়তে চাইছে না। শুধু
নমস্কার জানিয়ে মাথা নীচু করে বেরিয়ে আসে।
(২)
মাস খানেক আগেও অশোক বাবুকে দেখে ভীষন খারাপ লাগছিলো সন্তোষের।বহু বছর
পাশাপাশি থাকার ফলে খুবই কাছের আপন জন হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র মাস ছয়েক আগে সন্তোষ অন্যে যায়গায় পছন্দ সই একটি রিসেলের ফ্লাট কিনে চলে যায়।
মাঝে মধ্যে দেখা হয়েছে ফোনে কথা হয়েছে।এর পরেই দেশ জুড়ে শুরু হয় অতিমারী করোনার তান্ডব। অশোক বাবু তিন বছরের অয়নকে নিয়ে বেশ মুশকিলে আছেন। কোনো কিছুর অভাব নেই সারকারি বড় চাকুরি নিজস্ব বাড়ি গাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ও ভালো। দুর সম্পর্কের আত্মীয় স্বজন ছাড়া এক মাত্র বোন সেও বিয়ের পরেই স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।নিঃসন্তান অশোক বাবু বিবাহের দশ বছর পার করেও যখন কোনো আশার আলো দেখতে পায় না, যখন ডাক্তাররা স্পষ্টই জানিয়ে দিলেন আর কোনো ভাবেই অশোক বাবুর পক্ষে সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব নয়।এ কথা জানতে পেরেই স্ত্রী পুষ্প মানুষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে।পুষ্পকে সুস্থ করে তুলতেই ডাক্তার,শুভাকাঙ্খী,পরিচিত-পরিজনের পরামর্শ মেনে পুষ্পর মা ডাক শোনার ইচ্ছেকে এবং হাসি খুশী রাখতে সিন্ধান্ত নেয় দত্তক নেবার।
মাস খানেকের মধ্যে এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন মল্লিকা'র আর ওর ছেলের কথা।
এদিকে মল্লিকা অনেক ছোটাছুটি করছে যদি
ছেলের একটা ব্যবস্থা হয় কোথাও বা কোনো অনাথ আশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করতে পারে।
অশোক বাবু বন্ধুকে নিয়ে দেখা করেন মল্লিকার সাথে। মল্লিকার ছেলে অয়নকে দত্তক নেবার কথা জানায়।মল্লিকাও ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর আপত্তি করে না। তবে শর্ত একটাই প্রতি সপ্তাহের রবিবার দিন ছেলেকে ওর কাছে দিয়ে যাবে আবার রাতে এসে নিয়ে যাবে। এব্যাপারে অশোক বাবুও কোনো আপত্তি করে না। ভালোই কাটছিল ওদের দিন।পুষ্প ও খুশি। দত্তক ছেলে পেয়ে নিজের ছেলে মনে করে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে।মাতৃত্বের সাধ পূরনে। অল্প কিছু দিনের মধ্যে অয়নের মুখে আধো আধো স্বরে মা ডাক শুনে বুক জুড়িয়েছে।
রবিবার করে অশোক বাবু অয়নকে মল্লিকার কাছে সকালে দিয়ে আসে আবার সন্ধ্যার আগে গিয়ে নিয়ে আসে এভাবে কয়েক সপ্তাহ কাটার পর দেখা যায় অয়নের অনেক পরিবর্তন ঘটছে দিনে দিনে মল্লিকাকে নিজের মা হিসেবে ভুলতে বসেছে দু'তিন ঘন্টা থাকতে না থাকতেই কান্না কাটি শুরু করে দেয় মল্লিকার কাছে ইদানিংও যেতেই চাইছে না। মল্লিকা গোপনে চোখের জল ফেলে। কি করবে জোড় করে আটকে রাখতে পারে না। অয়ন তো এখন ওদের ছেলে। তাছাড়া
যে সন্তান নিজে মাকে ভুলতে বসেছে সেখানে বুকে পাথর চাপা দিয়ে মেনে নিতেই হয়।
অয়ন মল্লিকাকে মন্নি বলে ডাকে,মল্লিকা এটা সেটা দিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করেও লাভ হয় না।
অল্প দিনের মধ্যে মা ছেলের দূরত্বটা ভীষন ভাবে দেখা দেয়। মনের কষ্ট চেপে মল্লিকা ছেলেকে ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করবেনা ভাবে।
এছাড়াও সেদিন যখন অশোক বাবুর বাড়িতে
ঢুকছে আড়াল থেকে শুনতে পায়।পুষ্পর এই
কথা গুলো,পুষ্প অশোক বাবুকে বলছে-
আমরা তো কোনো আপত্তি করিনি বাবান কে
ওর কাছে নিয়ে রাখতে কিন্তু বাবান তো ওকে
চায় না পছন্দ করছে না,সেটা কি মল্লিকা বুঝতে পারছে না! তাহলে ছেলেকে দিলো কেন না দিলে তো আমরা জোর করে নিয়ে আসতাম না।ওর তো বোঝা উচিত। সেদিন মল্লিকা দেখা না করেই চলে আসে ওবাড়ি থেকে।নিজের ঘরে এসে খুব করে কাঁদে, বিছানায় লুটিয়ে পড়ে নিজের ভুল আর বোকামির জন্যে, ভাবে একটা মাত্র ছেলে
কে কাছে রাখার মতো কোনো যোগ্যতা ওর নেই,একি করলো ও। এর জন্যে তো ও কাউকে দোষ দিতে পারবে না তাছাড়া ওর ছেলেকে ওরা তো মাথায় করে রেখেছে। সে দিনের পর থেকে মল্লিকা ওবাড়িতে য়ায় না।অশোক বাবুও আর রবিবার হলে অয়ন কে দিয়ে আসে না। মল্লিকা চাতক পাখির মতো পথের দিকে তাকিয়ে থাকে এই বুঝি ছেলে এলো ! কই কেউ তো আসে না।
হঠাৎ যেন সব কিছু উল্টে পাল্টে যায় দেশে বিদেশে দেখা দেয় ভয়ঙ্কর রোগ অতি মহামারী করোনা। সবার সাথেই এক প্রকার যোগাযোগ দেখা সাক্ষাৎ প্রায়ই বন্ধ হয়ে য়ায়।একটা মোবাইল ফোন ছিলো মল্লিকার সেটাও বেশ কয়েক দিন আগে নষ্ট হয়ে গেছে,ভেবে ছিলো এমাসে বেতন পেলেই একটা কম দামের সেট কিনে নেবে কিন্তু লক ডাউন শুরু হয়ে যাওয়ায় আর কেনা হয়না। সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ।নিজে থেকে কারো খোঁজ খবর নিতে পারছে না ছেলেটার খবর পাচ্ছে না।এর মধ্যেই করোনা থাবায় আক্রান্ত হয় পুষ্প। হাসপাতাল ভর্তি থেকে ভালো হয়ে বাড়ি আসে। মাত্র পনের দিনের মাথায় হার্ট ব্লকেজ হয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে।অশোক বাবু ভীষন ভেঙ্গে পড়ে মনের দিক থেকে। কি করবেন ভেবে পায় না অয়ন প্রায়ই খাওয়া ঘুম ছেড়েই দিয়েছে।
মল্লিকা গোপনে চোখের জল ফেলে নিজেকে একজন হতভাগী মা ভেবে।ছেলের এমন সব আচরনে এতটাই কষ্ট পেতে থাকে ভাবে এমনকি পাপ ও করেছে যে নিজের পেটের ছেলেও ওকে ভুলে গেলো! বুকে পাথর চাপা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ওকে বাঁচাতেই তো এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।ভেবেছিলো আর যাই হোক সপ্তাহে অন্ততঃ একটা দিন ছেলেকে কাছে পাবে মা ডাক শুনতে পাবে কিন্ত সব কিছুই যেন উল্টো হয়ে গেলো।কেন এমন হলো ওর সাথে,এ কোন পাপের ফল!
ওর বেচেঁ থেকে কি হবে কার জন্যে বাঁচবে দিনে দিনে পেটের ছেলে পর হয়ে নিজের মাকে ভুলে গেলো এত অপ্ল সময়ে! এমনটা হবে বুঝলে কি এমন সিদ্ধান্ত নিতো। অনেক বড় ভুল হলো এ জীবনে কিন্তু এখন তো আর কিছুই করার নেই নিজের ইচ্ছেতে আইনের সমস্ত দিক মেনেই তো ছেলেকে ওদের কাছে দিয়ে দিয়েছে বিনিময়ে শুধু একটাই শর্ত রেখে ছিলো সেটা তো ওরা মেনেছে পালন করেছে।ওদের ওতো কোন দোষ দেওয়া যাবে না।যেখানে নিজের ছেলে চায় না মাকে মা বলে ডাকে না,ভুলে গেলো তার জন্যে আর মায়া বাড়িয়ে কি হবে !ও যাতে ভালো থাকে
মানুষের মতো মানুষ হয় সুস্থ থাকে ভগবানের
কাছে মা হিসেবে এটাই এক মাত্র প্রার্থনা।
(৩)
অশোক বাবু বেশ কিছু দিন ছুটি নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন তাতেই বুঝেতে পারে ওনার পক্ষে ছেলে সামলানো অসম্ভব।সব সময়ের জন্যে এ বাড়িতে থেকে রান্না-বান্না,ছেলের দেখাশোনা করার মতো এমন এক জন বিশ্বস্ত মহিলার খোঁজ করেও পাচ্ছে না। চাকরি থেকে অবসর নিতে এখনো
পাঁচ বছর।অনেকে অশোক বাবুকে পরামর্শ দেয় ছেলেকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আবার বিয়ে করতে।অনেক ভাবে অশোক বাবু।এবয়সে এসে বিয়ে করা কি উচিৎ হবে !নতুন বউ এসে অয়নকে মেনে নিতে পারবে ! অয়নও কি মেনে নিতে পারবে ! অয়ন যে ভাবে পুষ্পকে মা ভেবে জড়িয়ে ধরে ছিলো তেমনটা যদি না হয়এক্ষেত্রে!
ভেবেছিল মল্লিকাকে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে ওকেই ফেরত দেবে।মল্লিকার যাতে চাকরি করে খেতে নাহয়।তেমন কিছুর ব্যবস্থা করে দেবে।অয়নের বড় হয়ে ওঠা জন্যে যাতে কোন প্রকার সমস্যা অসুবিধায় পড়তে না হয়।তাছাড়া করবে না কেন দত্তক নিয়েছে নিজের ছেলের মর্যাদা দিতেই তো অয়নকে গ্ৰহন করেছে। নিজের যা কিছু স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি টাকা পয়সা আছে সবটাই তো আগামী দিনে অয়নের হবে।আর তো কেউ নেই যে তার কথা ভাববে। লক ডাউন কিছুটা হাল্কা হতেই এভাবনা কার্য্কর করার জন্যে অশোক বাবু মল্লিকার সাথে দেখা করতে গেলেন,গিয়ে দেখেন জানতে পারেন মল্লিকা ওবাড়িতে থাকে না। সপ্তাহ দুই আগেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।
কোথায় গেছে কাউকে কিছুই বলেনি।হঠাৎ করে বেপাত্তা।এমন কি সাথে করেও কিছু নিয়ে যায় নি।বিষয়টা সকলের কাছে অবাক করার মতো।
একজন জলজ্যান্ত সুস্থ মহিলা একা একা চলে গেলো,এনিয়ে আসে পাশের দু চার জন যে বাঁকা মন্তব্য করে নি তাও নয়।সেকথায় অবশ্য কান দেবার মানষিকতার মানুষ নয় অশোক বাবু উনি নিজে দেখেছে অল্প দিনের হলেও কথা বলেছে কখনো তেমন কিছু মনে হয় নি।খুবই ভদ্র ভালো স্বাভাবের মহিলা।লোভ লালসা বলতে কিছু নেই তা না হলে ছেলের বিনিময়ে যে টাকা দিতে চেয়ে ছিলেন অনায়াসে নিতেই পারতো বা আরো কিছু চাইতে পারতো।শুধু একটাই শর্ত করেছিল প্রতি রবিবার ছেলেকে ওর কাছে রাখবে।
মল্লিকার অফিসে খোঁজ করে জানতে পারে লকডাউনের পর অফিস খুলেছে, মল্লিকা আসেনি কোনো যোগাযোগও করেনি।কোথায় গেছে ওরা জানেনা।মল্লিকার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আরো
উল্টো কথা বলে।অবশ্য অশোক বাবু ওদেরকে ছেলের ব্যাপারে কিছুই জানায় নি।পরিচিত এক জন মানুষ হিসেবে খোঁজ করছে বলেই চলে আসে। সমস্যা হয়ে গেলো।কি করবে,কি করা উচিত কিছুই বুঝে উঠে পারছে না এভাবে আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলেও আর সম্ভব হচ্ছে না হাতেও বেশী সময় নেই, ভাবে,কয়েক দিনের জন্যে অয়নকে নিয়ে বাইরে কোথা থেকে ঘুরে আসবে তাতে যদি অয়নের মন ভালো হয় কিছু পরির্বতন ঘটে তা না হলে
ছেলে কে বাঁচাবে কি ভাবে।শেষে ঠিক করলেন উত্তর বঙ্গের দিক যাবেন।ট্রেনের টিকিট কেটেই হোটেল বুক করে রওনা দিলেন।
(৪)
সেদিন বিকেলে অয়নকে নিয়ে হোটেল থেকে
বেড়িয়ে হাঁটতে থাকেন চা বাগানের সরু পথ ধরে চারদিকে সবুজে ঘেরা চা বাগান দূরে নীল আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে পাহাড়, ছুটে আসা মুক্ত বাতাস অয়নের ভালো লাগছে বুঝতে পেরে আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা সুন্দর শিশু পার্ক দেখতে পেয়ে পার্কের ভেতরে গেলেন।
নানান পশু পাখি দোলনা দিয়ে এমন সুন্দর করে সাজানো পার্ক দেখে অয়ন বেশ খুশি হয়ে ছোটা ছুটি করতে থাকে।কয়েক জন মধ্যবয়সি লোক পার্কে বসে গল্প করছেন।ওরাই অশোক বাবুকে দেখে ডেকে জিজ্ঞাসা করে--মহাশয় কে দেখে তো এখান কার লোক বলে মনে হচ্ছে না। তা কোথা থেকে আসছেন?
অশোকবাবু দুটো কথা বলার লোক পেয়ে মনে মনে খুশী হয়ে ওনার পরিচয় দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে ফিরে এলেন হোটেলে।জায়গাটা বেশ ভালো লেগেছে অয়নের অশোক বাবুও গল্প করার মতো কয়েক জন লোক পেয়ে পর পর পার্কে আসতে শুরু করেন।গুরু চরণ নামেরএক ভদ্রোলোকের সাথে বেশ আলাপ জমে ওঠে।গুরু চরণ বাবুও জানায় ওনার বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছে অশোক বাবুর এলাকাতে মানে মধ্যম গ্ৰামে। ওখানে ওনার মেঝো ভাই থাকেন নাম বলতেই চিনতে পারেন।সেখান থেকে দুজনের ভাব হয়। বন্ধু হয়ে সংসার জীবনের সুখ দুঃখের কথা গল্প করেন। অশোক বাবু মুখে অয়ন আর মল্লিকার কথা জানতে পেরে গুরু চরণ বাবু কি সব যেন ভাবতে থাকেন।
অশোক বাবু জানতে চাইলে সে কথার উত্তর না দিয়ে জানতে চায়
-আর কদিন আছেন এখানে,কবে ফিরবে যাবেন কোলকাতায় ?
-ইচ্ছে আছে কুচবিহার রাজবাড়ি, মদনমোহনের মন্দির দর্শন করবো।এখান থেকে দুদিন পরেই বেড়িয়ে যাবো।ওখানে থেকে সোজা কোলকাতা।
পরের দিন সকালে গুরুচরণ বাবু হোটেলে এসে দেখা করে অশোক বাবুর সাথে। দুপুরে ওনার বাড়িতে খাবার নেমন্তন্ন করে।অশোক বাবু লজ্জা পেয়ে আপত্তি করলে বলেন
-আমার স্ত্রী আলাপ করতে চায় আপনার সাথে।মেয়ের শ্বশুর বাড়ির এলাকার লোক আপনি, বুঝতেই তো পারছেন ওকে তো হোটেলে নিয়ে আসতে পারি না। তাছাড়া দুজনে বন্ধু হলাম যখন তখন আর না কেন মশাই? আমি লোক পাঠিয়ে দেবো সে আপনাদের আমার বাড়িতে নিয়ে যাবে ।
অগত্যা যেতেই হবে। ভদ্রলোকের সন্মানার্থে।
দুপুরে খাবার পর্ব শেষ করে ওনারা গল্প করছেন অয়ন আর গুরুচরণ বাবুর ছেলের ঘরের নাতি এঘরওঘর ছোটা ছুটি করে খেলছে অশোক বাবু
যেন পরিচিত একজন ভদ্রমহিলাকে দেখতেপায় দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে। উঠে এগিয়ে গেলন কিন্তু ততোক্ষনে উনি বেরিয়ে গেছে।ফিরে এসে ভাবছে,দেখে মনে হয় মল্লিকা।নাকি দেখারভুল!
আরো একটু ভেবে গুরু চরণ বাবুকে বলতে-
গুরু চরণ বাবু অবাক হয়ে বলেন -
-বলেন কি মশাই ওর নাম তো তাপসী।পাশেই আমার দাদার বাড়ি।ওতো দাদার বাড়িতে থাকে মাস দুই এসেছে ,সে অনেক কথা ।
বসুন বলে উঠে গেলেন।অশোক বাবুও যেন একটা অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেলেন।
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে থাকেন-
ঠিক দেখেছে তো নাকি ওর দেখার ভুল! হয়তো মল্লিকার মতো দেখতে হঠাৎ এক পলক দেখেছে মাত্র ভালো ভাবে দেখার সুয়োগ হলো কোথায়!
তাছাড়া মল্লিকাএতো দূরে আসবে কি করে যত দুর জানা আছে একমাত্র শ্বশুর বাড়ি ছাড়া তো
ওর আর কোনো আত্মীয় পরিজন নেই এদেশে গুরু চরণ বাবুরা কি ওর .....!
নিজের কাছে কেমন যেন একটা বোকা বোকা
লাগছে এই ভেবে সত্যি যদি মল্লিকা না হয়ে তাপসী হয় গুরু চরণ বাবুরা কি ভাবেন !
কিছু সময় পরে গুরু চরণ বাবু তাপসী নামের মহিলাকে নিয়ে ফেরে ।ওরা মুখোমুখি হতেই
না কোনো ভুল দেখেনি এতো অয়নের মা সত্যি মল্লিকা।।যে মল্লিকাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে এক মাত্র অয়নের জন্যে,তানা হলে ছেলেটাকে সুস্থ সবল রাখা বড় করে তোলার কোনো পথ খোলা নেই।
মল্লিকা অশোক বাবুকে দেখে অবাক হয়। কেউ কিছু বলে উঠতে পারছে না। এর মধ্যেই পাশের ঘর থেকে খেলা করতে করতে বাচ্ছা দুটি এ ঘরে চলে আসে।
অয়ন মল্লিকাকে দেখা মাত্র থমকে যায়। কিছু ভেবে ছুটে যতে'ই মল্লিকা অয়নকে জড়িয়ে ধরে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।অয়ন শক্ত কাঠের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মুখ দেখে মনে হয় কিছুটা ভয় পেয়ে থাকবে।গুরু চরণ বাবু অশোক বাবুকে হাতের ইশারায় ডেকে পাশের ঘরে নিয়ে যায়।
(৫)
পরের দিন গুরু চরণ বাবুর দাদা রজনী বাবুর কাছে মল্লিকার সবকথা জানতে পারেন অশোক বাবু।সেদিন বিকেলের দিকে রজনী বাবুর বড় বাজার অঞ্চলের ডিউটি শেষ করে থানার দিকে রওনা দিয়েছেন জিপ নিয়ে হাওড়া ব্রীজের মুখে আসতেই নজরে আসে মল্লিকাকে হাওড়া ব্রীজের উপড় দেখেই বুঝতে পারেন মহিলা কিছু একটা
একটা অঘটন ঘটাতে চলেছে পুলিশের চোখ বলে কথা ঠিক তাই ব্রীজ থেকে ঝাপ দেবার মতলব করছে।মুহুর্তের মধ্যে ছুটে গিয়ে ধরে নিয়ে আসেন নিজের থানায়। জিজ্ঞাসাবাদ করে মল্লিকার কাছে ওর জীবনের সব কথা শোনে। বাড়িতে এসে গিন্নীকে সব কিছু জানাতেই রজনী বাবুর গিন্নী মল্লিকাকে থানা থেকে সে রাতেই বাড়িতে নিয়ে আসতে বলে।উনি নিজেও ভেবে দেখলেন আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কোলকাতা থেকে এখানে চলে আসবেন।স্বামী-স্ত্রী ছাড়াওদের সংসারে তো
আর কেউ নেই সব সময় ওদের সাথে থাকবার মতো একজন মানুষের ভীষন প্রয়োজন। ঠিক করলেন ওদের সাথে মল্লিকাকে নিয়ে আসবে।
মল্লিকার মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
কথায় আছে না, যখন যেটা ঘটবার সেটাতো ঘটবেই।এভাবেই আবার মল্লিকাকে খুঁজে পাবে বলেই এখানে এই উত্তর বঙ্গের দিনহাটা তে বেড়াতে আসা গুরুচরণ বাবুর মাধ্যমে মল্লিকার সন্ধান পাওয়া। কিন্তু মুশকিল হলো অয়ন যে মল্লিকাকে ভুলে গেছে জন্মদাত্রী মাকে মা বলে চিনতেই পারছে না এঅবস্থাতে কি করে সম্ভব মল্লিকাকে বলবে অয়নকে ফিরিয়ে নিতে আর অয়নকে ফিরিয়ে দিয়েও তো নিজে একা একা থাকতে পারবে না।
অশোক বাবু ঘুমের মধ্যেই যেন পুষ্পর গলায় শুনতে পেলেন, পুষ্প বলছে-মল্লিকার মধ্যে তুমি আমায় খুঁজে নাও তাহলেই দেখবে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে মল্লিকা ওর ছেলে পাবে অয়ন পাবে ওর মা আর আমি মল্লিকার ভেতরে তোমার পুষ্প হয়ে থাকবো।
তোমাদের এ মিলনে আমিও স্বস্তির সাথে শান্তি পাবো আমাদের অয়ন ও ভালো থাকবে।
সেদিন সকালে সন্তোষের ফ্লাটের সামনে একটা গাড়ি এসে থামে সন্তোষ বাজারের দিকে এগিয়ে যেতেও একবার থামে কে এলো কৌতূহল।দেখে গাড়ি থেকে একজন ভদ্রোলোক ভদ্র মহিলা নেমে দাঁড়ায় কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সন্তোষ ভদ্রলোক পেছন ফিরে থাকায় ঠিক বুঝতে পারছে না পরিচিত নাকি অপরিচিত কেউ !
ভদ্রোলোক ঘুরতেই দেখে অশোক বাবু,এগিয়ে
যায় সন্তোষ।অশোক বাবু ওকে দেখেই হাসতে হাসতে বলে--সেদিন বলেছিলাম না হঠাৎ তোমার চমকে দেবো। তাই চলে এলাম না জানিয়ে।
সন্তোষের আর বুঝতে বাকি থাকে না। জড়িয়ে ধরে অশোক বাবুকে বলে-
-খুব সুন্দর সারপ্রাইজ আমার জন্যে। সত্যি আমি ভীষন খুশী হলাম আপনাদের নতুন জীবন ভরে উঠুক আনন্দ খুশীতে।
*****
*গৌতম তালুকদার
৫১,প্রতাপ গড়, গরফা
যাদবপুর ,কোলকাতা-৭০০০৭৫
মোঃ-৯০০৭০৩৫৬৯১